শনিবার, ২১ Jun ২০২৫, ০৮:১৭ পূর্বাহ্ন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) সংলগ্ন পলাশী মোড়ে অস্থায়ী গরু-ছাগলের হাট বসিয়ে চাঁদাবাজি এবং ব্যবসায়ীকে রাতভর আটকে নির্যাতন ও লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের একাংশের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার একের পর এক প্রমাণ সামনে আসছে। কিন্তু ছাত্র সংগঠনটির পক্ষ থেকে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তো দূরের কথা; উল্টো নিজেদের দায় এড়াতে নতুন বয়ান ও প্রতারণামূলক প্রেস বিজ্ঞপ্তির আশ্রয় নিয়েছে।
দৈনিক আমার দেশের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত পূর্ববর্তী প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১৯ নম্বর কক্ষে দোকান মালিক সমিতির সদস্য সচিব কামরুজ্জামান আপনকে রাতভর আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল ঢাবি ছাত্রদলের একাংশ এবং ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের একটি চক্র।
এর আগে লালবাগ থানা ছাত্রদল সিন্ডিকেটের সাথে তাদের মারামারির ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী, আবাসিক শিক্ষক, প্রক্টোরিয়াল টিমের সদস্য ও নির্যাতনের শিকার ব্যবসায়ীর জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর এবং হলের আবাসিক শিক্ষকদের উপস্থিতিতে অভিযুক্তদের কাছ থেকে নেয়া মুচলেকায় নিজের দোষ স্বীকার করেছেন সেলিম রানা সিয়াম।
একইসঙ্গে তিনি সংঘর্ষের সময় ঢাবি ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয়ে তন্ময় নামের একজনের উপস্থিতির কথাও উল্লেখ করেন। তিনি (সেলিম রানা) মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী পরিচয় দেন। এছাড়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এসএম হল ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম, যিনি মুচলেকা গ্রহণের পুরো সময়টিতে উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছে হল প্রশাসন।
ঢাবি ছাত্রদলের পাঠানো প্রতিবাদপত্র নিচে সংযুক্ত করা হলো-
কিন্তু সংগঠনটির নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি সত্ত্বেও গত ৮ জুন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পুরো ঘটনার দায় অস্বীকার করে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, পলাশী হাট থেকে চাঁদাবাজির ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে ছাত্রদলের লালবাগ থানা ইউনিট ও এসএম হল-কেন্দ্রিক নেতাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। এবারের ঈদে সেই দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় যখন দুই পক্ষ বিরোধে জড়ায়।
উল্লিখিত মারামারির আগে লালবাগ থানা ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক নেছার উদ্দিন রাব্বিকে তার ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে “পলাশী বাজারে অবৈধ ছাগলের হাট বসিয়ে চাঁদাবাজি করছে একটি চক্র, লালবাগ থানা ছাত্রদল চাঁদাবাজদের রুখে দাঁড়িয়েছে” এবং “পলাশীতে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি” শীর্ষক লাইভ করতে দেখা যায়।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবার (৫ জুন) লালবাগ থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নেছার উদ্দীন রাব্বী, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম রুবেল, যুগ্ম আহ্বায়ক ইমন ও তাদের অনুসারীদের সাথে ঢাবির সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের কয়েকজন শিক্ষার্থীদের মারামারি বাঁধে। এ ঘটনায় ঢাবি শিক্ষার্থীরাই মার খেয়ে স্থান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।
লালবাগ থানার ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নেছার উদ্দিন রাব্বি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয়ে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছে খবর পেয়ে তিনি এবং তার সহযোগীরা মিলে এর প্রতিবাদ জানান। একপর্যায়ে কয়েকবার ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। পরে সেই সিন্ডিকেট চলে যায়।
এই দ্বন্দ্বের জেরই সরাসরি গিয়ে পড়ে কামরুজ্জামান আপন নামের ব্যবসায়ীর ওপর, যিনি পলাশী বাজার দোকান মালিক সমিতির সদস্য সচিব হিসেবে মূলত ‘হাট নিয়ন্ত্রণ’ ও ‘চাঁদা উত্তোলন’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন।
পরে বৃহস্পতিবার সারারাত ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সিন্ডিকেট আপনকে এস এম হলের ১৯ নম্বর কক্ষে আটকে রেখে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে বলে অভিযোগ করেন তিনি। আপন অভিযোগ করেন, তাকে রাতভর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে।
কিন্তু, এমন ফৌজদারি অপরাধের পরও আপন কোনো মামলা করেননি। নেননি কোনো আইনি সহায়তা।
এদিকে, আমার দেশের অনুসন্ধানকালে কামরুজ্জামান আপনকে জিজ্ঞাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, খোদ ভুক্তভোগী নিজেই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবং তিনি যুবদলের রাজনীতির সাথে জড়িত।
মামলা করেননি কেন- প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে কামরুজ্জামান আপন বলেন, “অফ দ্যা রেকর্ড আপনাকে একটা কথা বলি, ভাই-ব্রাদারদের সাথে ঝামেলায় যেতে চাই না। আমাকে তো এখানেই ব্যবসা করতে হবে।”
তিনি বলেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পলাশী বাজার থেকে আওয়ামী সিন্ডিকেট উৎখাত করার সময় ব্যাপক সহায়তা করেছিলেন ঢাবি সিন্ডিকেট। এরপর থেকে সিয়ামের সাথে তার দহরম-মহরম। মূলত তার পৃষ্ঠপোষকতায় সিয়ামরা পলাশীকে আখড়া বানায়। পরে ঢাবি সিন্ডিকেট লালবাগ সিন্ডিকেটের কাছে পরাস্ত হলে সম্পর্ক চোখের পলকে বদলে যায়।
প্রকৃতপক্ষে কে দায়ী? কারা সরাসরি নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত?
সেলিম রানা সিয়াম: ছাত্রদলের কর্মী পরিচয়ে পলাশী হাটে নিয়ন্ত্রণ হারানো সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা বাবু মিয়া; তিনি ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী হলেও ইয়ার ড্রপ দিয়ে এখনো পড়েন তৃতীয় বর্ষে। আইন বিভাগের এই শিক্ষার্থী এসএম হল ছাত্রদলের সঙ্গে জড়িত বলে জানা যায়। এছাড়া তারেক, কমল রায় ও মুজাহিদ হোসাইন পলাশ বহিরাগত হলেও ছাত্রদলের নাম ভাঙিয়ে পলাশী হাটে অর্থ আদায়ে নিয়োজিত। তাদের প্রথম দুজন (তারেক, কমল রায়) পড়েন ঢাকা কলেজে, এবং তৃতীয়জন পড়েন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটতে।
এদিকে ঘটনার পর থেকে অভিযুক্তদের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ছাত্রদলের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিভ্রান্তি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে সংবাদ প্রকাশের পর ঢাবি ছাত্রদল যে প্রতিবাদপত্র দিয়েছে, সেখানে দুটি বড় অসংগতি চোখে পড়ে।
প্রথমত, তারা দাবি করেছে যে, অভিযুক্ত বাবু মিয়া ছাত্রলীগের নেতা। অথচ ঘটনাস্থলে উপস্থিত আবাসিক শিক্ষকরা সরাসরি বাবু মিয়ার ছাত্রদল সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করেছেন। তার অতীত ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতা থাকলেও তিনি এখন ছাত্রদল সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য। বাবু ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী হলেও এখনো তৃতীয় বর্ষে পড়েন। অভিযোগ আছে, ঢাবিতে থেকে নানা ফায়দা হাসিল করতেই তিনি টানা ইয়ার গ্যাপ দিয়ে আসছেন।
দ্বিতীয়ত, সেলিম রানা সিয়ামকে জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন ‘জাতীয় ছাত্রসমাজের’ পরিচয় দিয়ে ছাত্রদল নিজেদের দায় এড়াতে চেয়েছে।
ছাত্রদলের প্রতিবাদপত্রে চার বছর আগে ২০২২ সালের শুরুর দিকে ঘোষিত আংশিক কমিটিতে ‘ছাত্রসমাজের’ সভাপতি হিসেবে সেলিম রানা সিয়ামকে দেখানো হয়। কিন্তু পরে তিনি ছাত্রদল নেতা তরিকুলের শেল্টারে (আশ্রয়) হলে ছিলেন বলে জানিয়েছেন হাউজ টিউটর অধ্যাপক ওমর ফারুক।
পাশাপাশি সিয়ামের লিখিত মুচলেকা, ঘটনাস্থলে উপস্থিতি এবং ছাত্রদল নেতাদের সরাসরি সম্পৃক্ততার ঘটনা সংগঠনটির পাঠানো প্রতিবাদপত্রে তুলে ধরা যুক্তিকে অসাড় করে দেয়। মূলত হলগুলোতে ছাত্রদলের কোনো কমিটি না থাকায় অভিযুক্তদের সাংগঠনিক পরিচয়ের অস্পষ্টতার সুযোগ নিচ্ছে সংগঠনটি।
নিচে হল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য সংযুক্ত করা হলো-
এদিকে, হাউজ টিউটর অধ্যাপক ওমর ফারুক জানান, ঘটনার ব্যাপারে মো. তরিকুল হল প্রশাসনকে সর্বপ্রথম অবহিত করেন। এবং মুচলেকা নেয়ার পুরো সময় সেখানে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তরিকুল আমার দেশকে বলেন, ‘‘আমি অভিযুক্ত সিয়াম আর বাবুকে চিনি না। কখনো দেখিওনি। তাদেরকে শেল্টার দিবো প্রশ্নই উঠে না। আমি এক্ষুনি হল প্রশাসনকে জেরা করবো।”
তিনি বলেন, ‘‘ভুক্তভোগী আপন এবং লালবাগ ছাত্রদল সেক্রেটারি রাব্বি তার দুর্দিনের সহযাত্রী ছিল। সে কারণে রাব্বির ফোন পেয়ে আপনকে উদ্ধার করতে খুব ভোরে হলে ছুটে যান তিনি। এবং নিজে উপস্থিত থেকে বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করেন।’’
অভিযুক্তদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহসের সাথে যোগাযোগ করে আমার দেশ। কিন্তু তিনি এ ব্যাপার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গনেশ বলেন, “আমরা প্রেস রিলিজ দিছি। ওইটাই আমাদের বক্তব্য। আপনি আবার নতুন করে কী জানতে চান আমার কাছে?”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরবতা, তথ্য হস্তান্তরে প্রভোস্টের গড়িমসি
এদিকে, ঘটনার পর অভিযুক্ত ছাত্রদল নেতাদের পরিচয় গোপন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন এস এম হলের প্রভোস্ট ও সাদাদল (ঢাবি শিক্ষকদের বিএনপি-জামায়াতপন্থী অংশ) নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন। ঘটনার দিন তার কাছে বিষয়টি সম্পর্কে থাকা লিখিত তথ্য চাওয়া হলে তিনি তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কাছে হস্তান্তর না করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। নানা অজুহাতে তথ্য হস্তান্তরের বিষয়টি তিনি বারবার এড়িয়ে যান।
এমনকি ঘটনা সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতেও নারাজ। উল্টো হাউজ টিউটরদের বরাত দিয়ে নিউজ করতে আমার দেশের এই প্রতিবেদককে ‘বয়ান’ দেন তিনি।
‘প্রভোস্ট অধ্যাপক মামুন লিখিত তথ্যগুলো না দিতে বারণ করেছেন’- এমনটি উল্লেখ করে হাউজ টিউটর অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, ‘‘আমরা অভিযুক্তদের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা নিয়ে এবং অভিযুক্ত সকলের নাম-পরিচয় লিখে নিয়ে একটি মুচলেকা নিয়েছি। প্রভোস্ট সাহেব এটি আপনাকে দিতে মানা করেছেন। আমি কেমনে দিই বলেন?”
এই ধরনের গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের পরও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ না নেওয়া এবং শুধুমাত্র মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরবতা অভিযুক্তদের রাজনৈতিক প্রভাব ও পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টিই ইঙ্গিত করছে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘ভুক্তভোগী নিজেই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত হওয়ায় তিনি কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। প্রাথমিকভাবে আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি। প্রতিবেদন আসলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’’
অন্যদিকে, অপরাধ সংঘঠিত হওয়ার পর ছাত্রদলের একটি বিশেষ অংশ নিয়মিতভাবে নিজেদের দায় এড়াতে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন, রাজনৈতিক পরিচয় গোপন বা বিকৃত উপায়ে প্রচার এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে পার পেয়ে যেতে চায়। এতে করে অপরাধীরা দিনকে দিন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের মতো বেপরোয়া হয়ে উঠছে, ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির সংস্কৃতি আরও গভীর হচ্ছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্বেগ জানাচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।