বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৪ অপরাহ্ন
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কুড়িগ্রাম অঞ্চলে এখন আর রাত নামে না, নামে শুধু অদৃশ্য উদ্বেগ। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সার্চলাইটের তীব্র আলো বাংলাদেশের নীরব গ্রামগুলোর ভেতরে কয়েকশ মিটার পর্যন্ত ঢুকে পড়ে। উজ্জ্বল এ আলোয় বিবর্ণ হয়ে যায় ধান, ভুট্টা ও সবজি। ঝরে পড়ে আম-লিচুর মুকুল।
আলোর আকর্ষণে দলবেঁধে নামা পোকামাকড় ফসলের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মানুষও রক্ষা পায় না। কাঁচা ঘরের চালা ভেদ করে ঢুকে পড়ে তীক্ষ্ণ আলো। এতে শিশুর ঘুম ভাঙে, বয়স্কদের চোখ জ্বলে, গৃহিণীদের মাথাব্যথা হয়। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক জীবনযাপন। নিরাপত্তার নামে সীমান্তের এ আলো আজ সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকার নতুন সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে।
কুড়িগ্রামের রাজিবপুর, রৌমারী, উলিপুর, নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলার ২৭৮ কিলোমিটারেরও বেশি সীমান্তজুড়ে বাস করেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ, যাদের প্রধান জীবিকা কৃষি। কিন্তু সেই কৃষিই এখন আলো-আক্রমণে বিপর্যস্ত।
২০০১ সালের বড়াইবাড়ী ঘটনার পর বিএসএফ সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের পাশাপাশি ২০০ মিটার অন্তর স্থাপন করে শক্তিশালী সার্চলাইট। সন্ধ্যার পর লাইট জ্বালানো হয়, বন্ধ হয় সকালে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব লাইটের আলো সীমান্ত থেকে প্রায় ৪০০ মিটার বাংলাদেশ অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। যতদূর পর্যন্ত আলো যায়, অনেকটাই দিনের মতো দেখা যায়।
কৃষকদের বরাতে জানা গেছে, ভারতীয় এসব লাইটের আলোয় বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কৃষকদের বেঁচে থাকার একমাত্র
অবলম্বন ফসলি জমির উর্বরতা জমে যায়, মাটি শুকিয়ে যায়। ধান গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়, শীষ ছোট হয়। অনেক সময় ধানের পাতা বেশি হয় কিন্তু ফলন কম হয়। পাটগাছ কম লম্বা হয়, গাছের বাকল শক্ত হয় না।
কৃষকরা আরো বলেন, রাতের অতিরিক্ত আলোয় আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় আক্রমণ করে। মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, সাদা মাছি, বিছা পোকা ধান-পাটসহ বিভিন্ন ফসল ও বিভিন্ন ধরনের সবজির মারাত্মক ক্ষতি করছে।
এলাকার চাষিরা জানান, সীমান্তবর্তী আম-লিচুর বাগানেও তীব্র আলোর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। আম ও লিচুর ফুল কম ধরে, ফুল ঝরে যায় এবং ফলন কম হয়। সুপারি, নারিকেল ও কলাগাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলন কম হয় এবং পোকার আক্রমণ বেশি দেখা যায়।
ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙার কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, ভারতের সার্চলাইটের আলোর কারণে ধানের পাতা হলুদ হয়, শীষ ছোট হয়। ভুট্টার ফুল কম হয় এবং মোচা ছোট হয়। এছাড়া আলু, মুলা, শিম ও লাউসহ বিভিন্ন সবজি গাছ ঝিম মেরে থাকে, ফলন ভালো হয় না। ওরা ইচ্ছা করলেই লাইটের পাওয়ার কম দিতে পারে অথবা নিচ দিকে দিতে পারে, কিন্তু দেয় না।
তার ভাই আবুল কালাম বলেন, বাতির বাইরে চাষ করা ধানে বিঘায় ১৫-১৬ মণ ফলন হয় আর বাতির নিচে আট মণও হয় না। ভাত তেতো লাগে, খেতেই পারি না। এমনকি ওই ধানের খড়ও গরু খায় না।
নিজের ক্ষেতে ছেলেকে নিয়ে ধান কাটার সময় কথা হয় রৌমারী সীমান্তের বকবান্দা ব্যাপারীপাড়া গ্রামের সফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, সীমান্তে বিএসএফের লাইটের কারণে ক্ষেতে পোকার আক্রমণ বেশি হয়। মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, সাদা মাছি এসব ফসল ও সবজির অনেক ক্ষতি করে। অন্যান্য জায়গায় দুবার কীটনাশক দিলেই হয় অথচ আমাদের দেওয়া লাগে চার থেকে পাঁচবার। আবার সারও বেশি লাগে।
কীটনাশক ব্যবসায়ীরাও স্বীকার করেন, সীমান্ত অঞ্চলে ওষুধ ও সার বিক্রি অন্য এলাকার তুলনায় অনেক বেশি।
সীমান্ত এলাকার কাঁচা ঘরে সার্চলাইটের আলো প্রবেশ করে ঘুমের মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায়। মাথাব্যথা, চোখে কম দেখাসহ বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হয় মানুষ।
রাতে টহলে থাকা বিজিবি সদস্যরাও জানান, তীব্র আলোয় তাদের চোখের সমস্যা বাড়ছে। তারা বলেন, সারা রাত আমরা ডিউটি করি, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন লাইটের আলো এসে একদম চোখ বরাবর পড়ে। পাকিস্তান সীমান্তে লাইট দিলেই ওরা গুলি করে ভেঙে ফেলে কিন্তু আমরা তো সেটা পারি না।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মির্জা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, উদ্ভিদ দিনের আলোয় সালোকসংশ্লেষণ করে, রাতে শ্বসন প্রক্রিয়া চালায়। রাতে কৃত্রিম তীব্র আলো দিলে এ চক্র ব্যাহত হয়, ফলে ফলন কমে এবং পোকামাকড় বাড়ে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চোরাচালান ও নিরাপত্তার অজুহাতে সার্চলাইট বসানো হলেও মূলত বাংলাদেশ সীমান্তের কৃষিকে ঝুঁকিতে ফেলতেই এমনটা করা হয়েছে।