রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:০৫ অপরাহ্ন
ইসলামি ধারার দুর্বল পাঁচটি ব্যাংক একীভূতকরণে সরকারের সম্মতি পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল রোববার একীভূতকরণ উদ্যোগ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে এ সম্মতি জানানো হয়। বৈঠকে উপস্থিত থাকা অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র মতে, একীভূত করার জন্য ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা মূলধন ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সরকার ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা দেওয়ার সম্মতি দিয়েছে। আর আমানত বিমা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নেওয়া হবে। বাকি সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করা হবে।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ডজনখানেক ব্যাংক লুটপাটের কারণে আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ওই সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকে বিশেষ তারল্য সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথম ধাপে ছয়টি ব্যাংকে সম্পদের গুণগত মান যাচাই (একিউআর) করে। ব্যাংকগুলো হলো- এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক। একিউআর প্রতিবেদনে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৮ শতাংশ থেকে ৯৮ শতাংশ বেরিয়ে আসে। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইসিবি ইসলামিক বাদে অপর পাঁচটি মিলে একটি ব্যাংক করার উদ্যোগ নিয়েছে।
একীভূত করার আগে গত সপ্তাহে পাঁচটি ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারাবাহিক শুনানি হয়। গত মঙ্গলবার বৈঠক হয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে। বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক বৈঠক করে এক্সিম ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের সঙ্গে। আর বৃহস্পতিবার বৈঠক হয় গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, চার ডেপুটি গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
ব্যাংক পাঁচটির পক্ষে অংশ নেন চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তা। বৈঠকে একীভূত হতে সম্মত হয়েছে তিনটি ব্যাংক। এগুলো হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। তবে একীভূত হওয়ার তালিকায় থাকা অন্য দুটি ব্যাংক সময় চেয়েছে। ব্যাংক দুটি হলো এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসব ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, একীভূত হওয়া ছাড়া ব্যাংকগুলোর সামনে আর কোনো পথ নেই। কারণ, তাদের সব সূচক খারাপ। গ্রাহকরা টাকা পাচ্ছেন না, ফলে পুরো খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্যাংকের ছয় হাজার কোটি টাকা এস আলম নিয়ে গেছে। তবে আমাদের সময় দিলে এবং মূলধন জোগান পেলে আমাদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।’
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন বলেন, ‘আমরা একটি রোডম্যাপ উপস্থাপন করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের আরো স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে তা উপস্থাপন করতে বলেছে। আমরা এটি সংশোধন করে পরবর্তী বৈঠকে উপস্থাপন করব।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংকের আমানত ধারাবাহিকভাবে কমে গত মে পর্যন্ত ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকায় নেমেছে। গত বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট আমানত ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। আমানত কমার বিপরীত চিত্র রয়েছে ঋণে। সুদসহ নিয়মিতভাবে ঋণস্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। গত মে পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। গত মার্চে যা ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে পাঁচটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণের যা প্রায় ৭৭ শতাংশ। বিপুল অঙ্কের এ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। শতাংশ বিবেচনায় সর্বোচ্চ ৯৮ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক। পর্যায়ক্রমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামীর ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮ শতাংশ। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার হিসেবে সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। পর্যায়ক্রমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী নিয়েছে ৭ হাজার ৫০ কোটি, এসআইবিএল ৬ হাজার ৬৭৫ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ২ হাজার ২৯৫ কোটি ও ইউনিয়ন ব্যাংক ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।