বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৩ অপরাহ্ন

বড় ভুল করে বসলো ইসরায়েল, এক হলো আরব-ইসলামিক বিশ্ব

আরব লীগ ও ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্য রাষ্ট্রপ্রধানেরা গত সোমবার কাতারের রাজধানী দোহায় এক জরুরি সম্মেলনে মিলিত হন। উচ্চপর্যায়ের এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ইসরায়েলের সেই হামলার মাত্র ছয় দিন পর, যেখানে দোহায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গাজা নিয়ে শান্তি আলোচনায় যুক্ত প্রতিনিধি দল অবস্থান করছিল।

কাতারের আমন্ত্রণে ডাকা এই সম্মেলনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল দোহায় ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের চলমান ঘটনা।

কাতারের সরকারি বার্তা সংস্থা প্রকাশিত চূড়ান্ত ঘোষণায় আরব ও ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধানেরা ২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর দোহায় ইসরায়েলের পরিচালিত “কাপুরুষোচিত ও অবৈধ হামলার” তীব্র নিন্দা জানান। ওই হামলায় আলোচনা-সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক প্রতিনিধি দলের জন্য নির্ধারিত আবাসিক ভবন, পাশাপাশি কয়েকটি স্কুল, নার্সারি ও কূটনৈতিক মিশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে এক কাতারি নাগরিকসহ কয়েকজন নিহত এবং বহু বেসামরিক মানুষ আহত হন।

ঘোষণায় বলা হয়, এই হামলা কাতারের ওপর সরাসরি আগ্রাসন এবং এটি ইসরায়েলের আগ্রাসী চরিত্রের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ, যা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

আরব ও ইসলামি নেতারা “ভ্রাতৃপ্রতিম কাতার রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ সমর্থন” পুনর্ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে ও যুদ্ধের অবসান ঘটাতে কাতার গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখছে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কাতারের পাশে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকার ঘোষণা দেন তারা।

তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতারও কড়া সমালোচনা করেন। নেতারা বলেন, এই নীরবতাই ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে লাগাতার আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছে, যা দায়মুক্তির নীতি জারি রাখছে, আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থাকে দুর্বল করছে এবং বৈশ্বিক নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলা ভেঙে দিচ্ছে।

তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান, যাতে ইসরায়েলের আগ্রাসন রোধ করা যায়। সতর্ক করে বলেন, নিষ্ক্রিয়তা চলতে থাকলে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।

এই সতর্কবার্তায় কাতারের ওপর হামলার পাশাপাশি গাজার দখলকৃত ভূখণ্ডে ইসরায়েলের নৃশংসতা, পশ্চিম তীরে দখলদারিত্বের বিস্তার এবং লেবানন, সিরিয়া ও ইরানের ওপর আগ্রাসনের কথাও উল্লেখ করা হয়।

আঞ্চলিক সমীকরণে পরিবর্তন

কাতারের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে সার্বভৌম ভূখণ্ডে ইসরায়েলের এই হামলা ব্যাপক নিন্দা কুড়িয়েছে এবং আঞ্চলিক সমীকরণ আমূল পাল্টে দিয়েছে।

এটি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের নগ্ন উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ায় (ইসরায়েল–আরব সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ) বড় ধাক্কা দিয়েছে।

এই হামলাই আরব লীগ ও ওআইসিকে জরুরি যৌথ সম্মেলনে বসতে বাধ্য করেছে, যেখানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) সদস্য ও গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী কাতারকে টার্গেট করা ইসরায়েলের বড় কৌশলগত ভুল।

এই পদক্ষেপকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং জাতীয় সার্বভৌমত্ব উপেক্ষা করে ইসরায়েলের ধারাবাহিক আগ্রাসনের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর ফলে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে যে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড পুরো অঞ্চলকেই হুমকির মুখে ফেলছে।

কৌশলগত মোড়

সম্মেলনের ফলাফলে আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়ায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার হুমকি আখ্যা দিয়ে কঠোর নিন্দা জানায়।

তারা শুধু নিন্দাতেই থামেনি; বরং কার্যকর পদক্ষেপের ডাক দিয়েছে। এর মধ্যে ছিল আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান।

এর ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অনেক সরকারকেও জনমতের চাপে প্রকাশ্যে সংহতি জানাতে হয়েছে।

স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া থেমে গেল

সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রচেষ্টায়। বিশেষ করে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্ভাব্য চুক্তি, যা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিতে অগ্রাধিকার ছিল; এখন কার্যত অনির্দিষ্টকালের জন্য ভেস্তে গেছে।

এতে ইসরায়েলের বিরোধীরা দীর্ঘদিন ধরে যে বক্তব্য দিয়ে আসছে, “স্বাভাবিকীকরণ শুধু দখলদার তেল আবিব শাসনকেই শক্তিশালী করে”—এটা আরও প্রমাণিত হলো।

কাতারের ওপর সামরিক হামলা ইসরায়েলের জন্য বড় কৌশলগত ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এর ফলে ফিলিস্তিন ইস্যু আবারও আঞ্চলিক কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে এসেছে এবং তথাকথিত সমন্বয়ের স্বপ্ন ভেঙে পড়েছে।

দোহা সম্মেলনে গৃহীত ঐকমত্য স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন এখানকার জনগণ ও রাষ্ট্রগুলো নিজেরাই।

 

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2024