বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪৯ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম :

ফৌজদারি কার্যবিধির সংস্কার

অপরাধীর বিচার ও শাস্তির জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১৮৯৮ সালে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনটি প্রণীত হয়েছিল। বিভিন্ন সময় প্রয়োজনের নিরিখে এর আগেও এই আইনটি অনেকবার সংশোধিত হয়েছে; কিন্তু জনহয়রানি রোধ, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি, অপরাধীর শাস্তি বিধান এবং নির্দোষীকে দ্রুততম সময়ে হয়রানিমুক্ত করতে এসব সংশোধনী খুব একটা ফলদায়ক হয়নি। তাই স্বল্প সময়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সোয়া শতকের এই আইনটির আমূল সংস্কার খুব প্রয়োজন ছিল। ফলে বিভিন্ন মামলায় উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এবং অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে এই সংশোধন করা হয়েছে।

বিদ্যমান ফৌজদারি কার্যবিধিতে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের জরিমানা করার এখতিয়ার ছিল মাত্র ১০ হাজার টাকা। সমাজে অপরাধ প্রতিরোধে এই জরিমানা ছিল খুবই অপ্রতুল, ফলে অপরাধীদের আইন আদালতকে গ্রাহ্য করার মানসিকতা ছিল না বললেই চলে। এবারের সংশোধনীতে ম্যাজিস্ট্রেটদের জরিমানা করার এখতিয়ার বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের জরিমানা করার ক্ষমতা ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষেত্রে ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা এবং তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষেত্রে ২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে।

আসামি গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণগুলো ফৌজদারি কার্যবিধিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন ৪৬-এর ধারায় বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার করার সময় গ্রেপ্তারকারীর নেমপ্লেট থাকতে হবে, নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে এবং পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। যে ক্ষেত্রে আসামিকে তার বাড়ির বাইরে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়, সে ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের পর অবিলম্বে (যা কোনোভাবেই ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না) আসামির পরিবার বা নিকটজনকে জানাতে হবে।

গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির সুরক্ষায় এবারের সংশোধনীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো ‘মেমোরেন্ডাম অব অ্যারেস্টে’র প্রবর্তন (ধারা ৪৬-এ)। গ্রেপ্তারের সময় আসামিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ধারা ৪৬-ক থেকে ৪৬-ঙ অন্তর্ভুক্ত করে এ সম্পর্কিত একটি ফর্ম যুক্ত করা হয়েছে। যেকোনো গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেই পুলিশকে এখন থেকে ‘মেমোরেন্ডাম অব অ্যারেস্ট’ প্রস্তুত করতে হবে। এই ফর্মে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির আইনি সুরক্ষাগুলোর একটি চেকলিস্ট রয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিকে উপস্থাপনের সময় এই ফর্মটিও দাখিল করতে হবে।

গ্রেপ্তারকৃতের তথ্য পেতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির পরিবারকে ভয়ানক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। গ্রেপ্তারকৃতকে কেন বা কোন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছে, তার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা যাবেÑএ-সম্পর্কিত তথ্যপ্রাপ্তি খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। নতুন বিধান যুক্ত করে এ সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। ৫৪-এর ধারায় বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারের সময় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে হবে। আবার ৪৬-বি এবং ৪৬-সি ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিটি গ্রেপ্তারের তথ্য গ্রেপ্তারকারীর অফিসের রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি যে থানা এলাকা থেকে আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই থানার সাধারণ ডায়েরিতেও এন্ট্রি করতে হবে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির পক্ষে কেউ থানায় যোগাযোগ করলে তাকে গ্রেপ্তার সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য অবশ্যই সরবরাহ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতি থানা, জেলা ও মহানগর পুলিশ অফিসে প্রতিদিন গ্রেপ্তারের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।

আমলযোগ্য অপরাধে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশের ক্ষমতা আরো সুনির্দিষ্ট ও জবাবদিহিমূলক করা হয়েছে। নতুন সংশোধনীতে আমলযোগ্য অপরাধে কাউকে বিনাপরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে হলে পুলিশকে দেখাতে হবে, পুলিশের সামনে ওই ব্যক্তি অপরাধটি ঘটিয়েছেন। তদন্তাধীন মামলার ক্ষেত্রে অপরাধটি ওই ব্যক্তি করেছেন মর্মে পুলিশের সন্দেহ করার যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হবে। নতুন সংশোধনীতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো, আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে আসামিকে গ্রেপ্তার করা কিংবা না করা উভয় ক্ষেত্রেই পুলিশকে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। একই সঙ্গে কোনো ব্যক্তিকে নিবারণমূলক আটক করার প্রয়োজনে ৫৪ ধারার বিধান প্রয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

গ্রেপ্তার সম্পর্কিত যেসব বিধান আইনে আছে, সেগুলো সঠিকভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি নাÑতা দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেটকে। কোনো ব্যত্যয় পাওয়া গেলে আদালত অবহেলাকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাকরিবিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিতে পারবে।

একজন আসামিকে কতদিন পর্যন্ত পুলিশ রিমান্ডে রাখা যায়, সে ব্যাপারে ফৌজদারি কার্যবিধির বিদ্যমান বিধান অস্পষ্ট। এবার ১৬৭ ধারায় সংশোধন করে বলা হয়েছে, এক মামলায় কোনোভাবেই ১৫ দিনের বেশি পুলিশ রিমান্ড নয়। একই সঙ্গে রিমান্ডে পাঠানো আগে-পরেও আসামির স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। রিমান্ডে নির্যাতন করলে এবং আসামির শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেলে ম্যাজিস্ট্রেট আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেনÑএমন বিধান যুক্ত করা হয়েছে।

এখন থেকে এক মামলার আসামিকে অন্য মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখাতে চাইলে পুলিশকে আদালতে আসামি ও পুলিশ ডায়েরি উপস্থাপন করতে হবে এবং আসামিকে শুনানির সুযোগ দিতে হবে।

ফৌজদারি কার্যবিধিতে প্রথমবারের মতো তদন্তের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৭৩-বি ধারায় বলা হয়েছে, এখন থেকে যেকোনো মামলার তদন্ত সাধারণভাবে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এই সময়সীমার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব না হলে বিস্তারিত কারণ এবং প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সময় প্রার্থনা করে তদন্তকারী প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তের সময়সীমা বর্ধিত করতে পারবেন। বর্ধিত সময়ের মধ্যেও তদন্ত সম্পন্ন না হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আবার তার কারণ ব্যাখ্যা করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রতিবেদন পেশ করবেন। তদন্তকারীর গাফিলতি প্রতীয়মান হলে ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজন মনে করলে তদন্তকারী পরিবর্তন বা তদন্তকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে পারবে।

সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের আর্থিক এখতিয়ার বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে এই মূল্যমান বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্ষেত্রে এক বৈঠকেই আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে এবং যেকোনো স্থানে সংক্ষিপ্ত বিচার আদালত পরিচালনা করা যাবে।

আগের আইনে অনুপস্থিত আসামির বিচারে ক্রোকি ও হুলিয়া পরোয়ানা ছিল শুধু দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টিকারী একটি প্রক্রিয়া। ৩৩৯-বি ধারা সংশোধনের ফলে আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার করার জন্য ক্রোকি ও হুলিয়া পরোয়ানা জারির কোনো আবশ্যকতা আর থাকছে না। ফলে পলাতক আসামির মামলা দ্রুততর সময়ের মধ্যে বিচারের জন্য প্রস্তুত হবে। একই সঙ্গে পলাতক আসামিকে আদালতে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দুটি পত্রিকার পরিবর্তে একটি বাংলা পত্রিকায় এবং পাশাপাশি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার বিধান সন্নিবেশ করা হয়েছে।

বেআইনি সমাবেশ সম্পর্কিত দণ্ডবিধির ১৪৩ ধারাকে আপসযোগ্য করা হয়েছে। এখন থেকে আদালত নিজে আপস কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে পারবে এবং পাশাপাশি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে আপসের জন্য মামলা পাঠাতে পারবে। শুধু তাই নয়, আপসের ভিত্তিতে কোনো চুক্তি সম্পাদিত হলে সেই চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নে আদালত প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।

সাজার পরিবর্তে প্রবেশন অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেয়। জামিন দেওয়ার সময়ও আদালত প্রবেশের যুক্তিসংগত ন্যায্য যেকোনো শর্ত ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণের শর্ত আরোপ করতে পারবে, যা সংশোধনমূলক বিচার প্রক্রিয়ার জন্য দারুণ সহায়ক হবে।

ফৌজদারি মামলায় মূল ভোগান্তি হলো মামলা হওয়ার পর থেকেই তারিখে তারিখে আদালতে হাজিরা দেওয়া। হাজিরা দিতে একটু ব্যত্যয় ঘটলেই আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়। এবারের সংশোধনীতে তদন্ত চলাকালে আসামির হাজিরা শিথিল করা করা হয়েছে। ৫৪০-এর ধারায় বলা হয়েছে, আদালত চাইলে তদন্ত রিপোর্ট শুনানি পর্যন্ত জামিনপ্রাপ্ত আসামিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে। এ সময় আসামি তার আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারবেন। আগে ২০৫ ধারার অধীনে এ ধরনের প্রতিকার সীমিত আকারে শুধু মামলা আমলে গ্রহণের পর প্রযোজ্য ছিল। নতুন আইনে স্পষ্ট বিধান যুক্ত হওয়ায় সারা দেশের অসংখ্য জামিনপ্রাপ্ত আসামি ব্যক্তিগত হাজিরার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবেন।

একই সঙ্গে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে কোনো আসামি উপস্থিত না থাকলেও এখন থেকে আসামির আইনজীবী আদালতের অনুমতিক্রমে সাক্ষীদের জেরা করতে পারবেন। এতদিন পর্যন্ত এই সুযোগ নিতে হলে অন্তত একজন আসামি আদালতে উপস্থিত থাকতে হতো।

ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে কোনো মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে মামলাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ আগে ঐচ্ছিক ছিল (২৫০ ধারা)। বর্তমানে এটিকে ম্যাজিস্ট্রেটের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব করা হয়েছে। একই সঙ্গে মিথ্যা মামলার সর্বোচ্চ অর্থদণ্ড ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ টাকা এবং ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ১ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা কমবে আশা করা যায়।

এছাড়া নতুন সংশোধনীতে ডিজিটাল মাধ্যমে সমন জারি এবং অনলাইনে বেলবন্ড দাখিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে। বেত্রাঘাতের মতো অবমাননাকর সাজা সম্পর্কিত সব বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে।

এক কথায় বিচার প্রক্রিয়ায় দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যেসব আইনি কারণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা দূর করে বিচারপ্রার্থী মানুষের দীর্ঘদিনের চাওয়া পূরণ করা হয়েছে।

আদালত অঙ্গনে হয়রানিমুক্ত ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে এই সংশোধনী অনেক ফলপ্রসূ হবে আশা করা যায়।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved Meherpur Sangbad © 2025