শনিবার, ২১ Jun ২০২৫, ০৭:১৩ পূর্বাহ্ন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে বিভিন্ন ইস্যুতে চাপে ফেলার কৌশল নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে বিএনপিতে। দলটির নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ মনে করে, তার মতো সর্বজনগ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন সারকারকে চাপে ফেলে দাবি আদায়ের কর্মসূচি কতদূর টেনে নেওয়া যাবে। তা ছাড়া ড. ইউনূস চাপে পড়লে পরোক্ষভাবে লাভবান হবে পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দোসররা।
অন্যদিকে নীতিনির্ধারকদের আরেকটি পক্ষ মনে করে, দায়িত্ব নেওয়ার পর ৯ মাস চলে গেলেও এখন পর্যন্ত নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি। এজন্য চাপ না দিলে সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ তো দেবেই না, বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়তে আরো বিলম্ব করতে পারে।
বিএনপি গত ১৯ মে স্থায়ী কমিটিতে সিদ্ধান্ত নেয় যে, দলটি ধীরে ধীরে সরকারের ওপর চাপ বাড়াবে। এরই অংশ হিসেবে মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের শপথ এবং ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার দাবি- এ দুই ইস্যুতে রাজপথে লাগাতার কর্মসূচি দেয়।
ইশরাক ইস্যুতে গত ১৪ থেকে ২২ মে ৯ দিন রাজধানীতে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের টানা উপস্থিতি ছিল ঢাকাবাসীর ব্যানারে। ইশরাককে মেয়র হিসেবে শপথ না পড়ানোর রিট হাইকোর্ট খারিজ করে দেওয়ার পরও তার সমর্থকরা রাজপথ ছাড়েননি। বরং ইশরাক সেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন, দুই উপদেষ্টা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তাদের অবস্থান রাজপথেই থাকবে।
তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সিঙ্গাপুর থেকে হাইকোর্টের রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে উল্লেখ করে নেতাকর্মীদের প্রতি আহবান রাখেন- জনগণের স্বস্তির জন্য রাস্তা থেকে সরে যান। এরপরই ইশরাক সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে রাজপথ থেকে তার সমর্থকদের প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন। তবে তিনি বলেন, আমরা দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছি। সে দাবিতে অনড় থাকব। আমরা ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা সরকারকে পর্যবেক্ষণ করব। এর মধ্যে দুই উপদেষ্টা পদত্যাগ না করলে আবারও মাঠে নামব।
অপরপক্ষে একই দিন গত বৃহস্পতিবার সাম্য হত্যার বিচার দাবিতে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থান করে ছাত্রদল। এতে রাজধানীর সড়কে প্রভাব পড়ে। জনগণের ভোগান্তি বাড়ে। পরে কর্মসূচির সমাপ্তি টেনে ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, সাম্য হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার না করলে প্রয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ব্লকেড করা হবে।
কবে নাগাদ কর্মসূচি দেওয়া হবে- জানতে চাইলে ছাত্রদল সভাপতি গতকাল শুক্রবার আমার দেশকে বলেন, সাম্য হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত যে তিনজন ধরা পড়েছে, তারা রিমান্ডে কী তথ্য দেয় এবং সে আলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী ব্যবস্থা নেয়, তা দেখে পরবর্তী কর্মসূচি নেওয়া হবে।
গত বৃহস্পতিবার সকালের দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর বৈঠকেও এসব বিষয় আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্র নিশ্চিত করেছে, উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠক শেষে অনির্ধারিত আলোচনায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে ক্ষোভ ও হতাশার কথা তুলে ধরেন তিনি।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসিকে জানান, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন’। এর আগে থেকেই জোর গুঞ্জন চলতে থাকে ড. ইউনূসের পদত্যাগের কথা।
এদিকে, ড. ইউনূসের পদত্যাগ ইস্যুতেও বিএনপিতে মতপার্থক্য দেখা যায়। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগসহ তার নেতৃত্বাধীন সরকারকে চাপে ফেলার পক্ষে নয়। তারা বর্তমান সরকারকে আরো সময় দিতে চান। ইশরাক সমর্থকদের রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার আহবান থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, বিএনপি মহাসচিবসহ দলটির এ অংশটি কোনো চাপে না ফেলে ড. ইউনূসকে আরো সময় দিতে চায়।
এর প্রমাণ হিসেবে মির্জা ফখরুলের জামাতা ফাহাম আবদুস সালামের ফেসবুক স্ট্যাটাসের কথা উল্লেখ করেন। তিনি সেখানে বলেন, বাংলাদেশের সব পলিটিক্যাল অ্যাক্টর বিশেষ করে বিএনপি ও এনসিপি নেতাদের প্রতি অনুরোধ করবÑ দয়া করে একে ওকে পদত্যাগ করার চাপ দেওয়া থেকে বিরত হোন। আমরা একটি বিশেষ সময় অতিবাহিত করছি।
বলাই বাহুল্য, আমাদের সব ইনস্টিটিউশন ভেঙে পড়েছে। কারো পারফরম্যান্সই খুব ভালো নয়। আগামী ৫ থেকে ১০ বছর আমাদের আওয়ামী লীগের কাফফারা দিতে হবে। তার সব কর্মকাণ্ড আমাদের সবার ভালো লাগবে না। কিন্তু তার ওপর আস্থা রাখুন। তাকে কোণঠাসা করে আমাদের খুব লাভ হবে না।
দেখেন, আমাদের একটা নতুন জাতি। আমাদের সিনিয়রদের ম্যাচিউরিটির প্রমাণ দিতে হবে। অপছন্দনীয় জিনিস নিয়ে আমাদের চলা শিখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা- আমাদের সিভিলাইজড ওয়েতে সমস্যা সমাধান করা শিখতে হবে। সবাই পদত্যাগ করলে সমস্যা কমবে না; বরং বাড়বে। এ সরকারকে কোনোভাবেই ফেল করতে দেওয়া যাবে না। আপনারা দয়া করে কথা বলুন নিজেদের মধ্যে।
নির্বাচন বাংলাদেশে হবে, মানুষ ভোট দেবে এবং কেউ না কেউ নির্বাচিত হবে। এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের তরুণরা যেন সিস্টেমের ওপর ভরসা হারিয়ে না ফেলে। সবাই একটু ঠান্ডা হই। ভুলে যাবেন না যে, আমাদের নিজেদের একটা পার্সোনাল জার্নিও শুরু হয়েছে ৫ আগস্টের পর। এটাই বড় জার্নি।
সূত্রটি জানায়, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহদেদসহ দলটির তরুণ অংশটি সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর পক্ষে। তা ছাড়া তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ চাননি। তবে তিনি পদত্যাগ করলে তাতে সালাহউদ্দিনের আপত্তি নেই।
এ ব্যাপারে আমার দেশ-এর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইনি। ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছি। উনি যদি রোডম্যাপ দেওয়ার পরিবর্তে নিজে পদত্যাগ করতে চান, তাহলে সেটা ওনার নিজস্ব চয়েস হতে পারে। কিন্তু আমরা ওনার পদত্যাগ চাইনি। আমরা পদত্যাগ চেয়েছি নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের।
পদত্যাগ চেয়েছি দুজন ছাত্র উপদেষ্টার। যেহেতু সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। একান্ত তিনি দায়িত্ব পালন করতে না চাইলে রাষ্ট্র বসে থাকবে না, জাতি বসে থাকবে না। জাতি তার বিকল্প খুঁজে নেবে। পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়। এখন রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়, আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করার বিষয় নয়।’
তবে স্থায়ী কমিটিতে চাপে রাখার বিষয়ে কোনো দ্বিধাবিভক্তি ছিল কি নাÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা যেকোনো সিদ্ধান্ত স্থায়ী কমিটিতে নিলে সেটা স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত। এখানে মত-দ্বিমত নেই।
অপরদিকে পদত্যাগ ইস্যুতে বিএনপিতে চাপ ও দ্বিধাবিভক্তি আছে কি নাÑ জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, না, না। আমাদের মধ্য এ বিষয়ে কোনো চাপ ও দ্বিধাবিভক্তি নেই। আমরা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে পদত্যাগ করতে বলিনি। যারা বিতর্কিত উপদেষ্টা আছে, আমরা তাদের বাদ দেওয়ার কথা বলছি।
তিনি আরো বলেন, বিএনপি চাচ্ছে না উনি (প্রধান উপদেষ্টা) পদত্যাগ করুন। আমরা চাচ্ছি নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে উনি চলে যাবেন। বিএনপির পক্ষ থেকে পদত্যাগের কথা কেউ বলেনি। আমরা যদি ডিসেম্বরে নির্বাচন করি তাহলে তো কেয়ারটেকার মুডে সরকারকে চলে আসতে হবে। কেয়ারটেকার মুডে এলে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের রেখে নির্বাচন করলে সেটা সুষ্ঠু ভোট হবে না। এজন্য আমরা বলছি বিতর্কিত উপদেষ্টাদের পদত্যাগ করতে। আমাদের এখন একটাই চাওয়া, উনি দ্রুততম সময়ের মধ্য নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন। এর বাইরে কিছু চাওয়া হয়নি।
অনির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা থাকতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস সাহেব চলে যাওয়ার কিছু নেই। ওনাকে নির্বাচন দিয়ে যেতে হবে। সরকার গঠনের ১০ মাস হয়ে গেছে, এখনো নির্বাচনের রোডম্যাপ দিচ্ছেন না। একটি অনির্বাচিত সরকার কতদিন চলতে পারে। আমরা ১৫-১৬ বছর যুদ্ধ করে শেখ হাসিনাকে বিদায় করেছি। অনির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা থাকতে পারে না।
দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ড. ইউনূস ১৮ কোটি মানুষের, আমরা আপনার পদত্যাগ চাই না। বিশ্বদরবারে আমাদের গর্বিত করেছেন, আপনি নোবেলজয়ী। আপনি ব্যক্তি ইউনূস নন, বাংলাদেশের ১৮ কোটির ড. ইউনূস। কিন্তু গতকাল আমি বিস্মিত হয়েছি। পত্রিকায় দেখেছি, কতটুকু সত্য জানি না, এনসিপি নেতাকে বলেছেন, আমার পদত্যাগ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ খবর কতটুকু সত্য জানি না। এতে আমার মনটা বড় খারাপ হয়েছে।