শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১২ পূর্বাহ্ন
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চরমে উঠেছে দলটির মিত্রদের। বিএনপির ঘোষণা করা ২৭২ আসনের প্রার্থী তালিকা কেন্দ্র করে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিনের সহযোগী বাংলাদেশ লেবার পার্টি ইতোমধ্যেই বিএনপির সঙ্গে দুই দশকের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারাও।
শরিক দলের অভিযোগ, আসন ভাগাভাগি বা সমঝোতার কোনো আলোচনা না করে বিএনপি হঠাৎ অধিকাংশ আসনেই নিজের প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে। তাদের দাবি, প্রতিপক্ষ জামায়াতে ইসলামী শরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ালেও বিএনপি উল্টো নিজ মিত্রদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এতে বিএনপির ওপর শরিকদের আস্থাহীনতা বাড়ছে।
বিএনপির দাবি, যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের অপেক্ষা করতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। দলটি আগেই ঘোষণা দিয়েছে, সবাইকে সবার যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হবে। বিশেষ করে যারা নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন, তাদের আসন ছাড় দেওয়া হবে আর যারা জয়ী হতে পারবেন না, তাদের সরকারে মূল্যায়ন করা হবে।
সম্প্রতি ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। পরে একটি আসনের প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার ৩৬ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে বিএনপি। এ তালিকায় ১২ দলীয় জোট, সমমনা জোট ও লেবার পার্টির শীর্ষ নেতাদের প্রত্যাশিত তিনটি আসনে বিএনপি নিজস্ব প্রার্থী দেওয়ায় মিত্রদের মধ্যে ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। এর মধ্যে ১২ দলীয় জোটের শরিক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা কিশোরগঞ্জ-৫, নড়াইল-২ আসনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ এবং বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ঝালকাঠি-১ আসন থেকে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
যুগপৎ শরিকদের প্রত্যাশিত আসনে বিএনপি প্রার্থী দেওয়ায় বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে ১২ দলীয় জোট। শরিক দলের নেতাদের অভিযোগ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন ও সরকার গঠনে যেসব দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২৭২টি আসনে প্রার্থী ঘোষণার মাধ্যমে সেই প্রতিশ্রুতিরই বরখেলাপ হয়েছে। তাদের দাবি, কোনো আলোচনাই হয়নি, অথচ সব আসনেই বিএনপি নিজেরাই প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে।
জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা জানান, এ পরিস্থিতিতে সামনে কীভাবে এগোবে জোট- এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান জানাতে আগামী ৮ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করবে ১২ দলীয় জোট।
এদিকে ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বে লেবার পার্টি গতকাল শুক্রবার জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা শেষে বিএনপির সঙ্গে পথচলা আনুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। লেবার পার্টি জানায়, দুঃখজনকভাবে বিএনপি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ভ্রাতৃত্ব, যৌথ সংগ্রাম ও মিত্রতার সম্পর্ককে অবজ্ঞা করে শরিক দলের সঙ্গে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে সমমনা দলগুলোকে মাইনাস করে এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, যা রীতিমতো প্রতারণামূলক, অমর্যাদাকর ও বেঈমানিপূর্ণ আচরণ।
লেবার পার্টির দাবি- আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠন একসঙ্গে করার প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তারেক রহমান চিহ্নিত চাঁদাবাজ, হত্যা মামলার আসামি, দুর্নীতিবাজ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিয়েছেন। আমরা শুনেছি, বিএনপি টাকার বিনিময়ে অযোগ্য, ফ্যাসিবাদী শক্তির দোসর এবং অনৈতিক ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিয়ে হাজার কোটি টাকার মনোনয়ন-বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছে। এমন কর্মকাণ্ড বিএনপির নৈতিক নেতৃত্বকে সম্পূর্ণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং তাদের রাজনৈতিক চরিত্রকে আরো দুর্বল করেছে।
লেবার পার্টির নির্বাহী কমিটি মনে করে, শরিকদের প্রতি অবজ্ঞা, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, নীতিহীন মনোনয়ন প্রক্রিয়া এবং বেঈমানিপূর্ণ আচরণের মধ্য দিয়ে বিএনপি নিজেকে বন্ধুহীন, বিশ্বাস ভঙ্গ ও নেতৃত্বহীন দলে পরিণত করেছে। এমন কর্মকাণ্ডে বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব উন্মোচিত হয়েছে। ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক শক্তিই তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারবে না- এ দায় সম্পূর্ণ বিএনপির।
বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে কি না, এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষনেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক আমার দেশকে বলেন, আমরা তফসিল পর্যন্ত দেখব। বিএনপি আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করে, তার ওপর নির্ভর করবে সম্পর্ক।
সাইফুল হকের দাবি, গণতন্ত্র মঞ্চ ইতিমধ্যে ৩০০ আসনে প্রার্থী নিয়ে কাজ করছে। আমরা তফসিল পর্যন্ত দেখব, তারপর স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেবে মঞ্চ।
তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে আলোচনা এখনো শেষ হয়নি। তবে বিএনপির লক্ষণ ভালো দেখছি না। তাদের প্রতি অবিশ্বাস বাড়ছে। যেখানে জামায়াতে ইসলামী মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে, সেখানে বিএনপি সম্পর্ক কমাচ্ছে। আমাদের মনে হয় বিএনপির আত্মবিশ্বাস বাড়ছে এককভাবে সরকার গঠনের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, বর্তমানে ওমরাহ পালনের জন্য তিনি সৌদি আরব অবস্থান করছেন। দেশে ফিরলে তিনি এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেবেন। শরিকদের আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, নির্বাচন জয়-পরাজয়ের বিষয়। এখানে শরিক দলের নেতা হোক আর বিএনপির নেতা হোক, যারা জিতে আসতে পারবে তাদের মনোনয়ন দেবে বিএনপি।
শরিকদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির এ নেতা বলেন, বিএনপি মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে আগামী দিনে জাতীয় সরকার গঠন করবে। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা হবে। যারা নির্বাচনি আসনে জিতে আসতে পারবে, তাদের আসন ছাড় দেওয়া হবে আর যারা জিততে পারবে না, তাদের সরকারে মূল্যায়ন করা হবে।