বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫৭ অপরাহ্ন

ভারত হাসিনার বিষয়ে ঝুঁকি নেবে না

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসির রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন হাসিনা। তাকে ফেরত চেয়ে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছে ঢাকা। এখন ভারত হাসিনাকে ফেরত দেবে কি না এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। এ বিষয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটে লিখেছেন পত্রিকাটির দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক সুধা রামচন্দ্রন। তার লেখাটি তুলে ধরা হলো:

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ করে ভারতকে নোট ভারবাল (আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক বার্তা) পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে তাঁদের অনুপস্থিতিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। রায়ের পাঁচ দিন পর ভারতকে তাঁদের প্রত্যর্পণের আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠানো হয়।

ঢাকার পক্ষ থেকে দিল্লির কাছে আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণ অনুরোধ আসবে—এটা আগেই ধারণা করা হয়েছিল। ১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কড়া ভাষায় ভারতকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রত্যর্পণের আহ্বান জানায়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর হাসিনা ভারতে পালিয়ে আসেন। তখন থেকেই তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই তিনি বিবৃতি দিচ্ছেন ও সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, যা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে।

গত এক বছরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বারবার শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য তাঁর প্রত্যর্পণের বিষয়টি উত্থাপন করেছে। তবে ভারত এসব অনুরোধের কোনো জবাব দেয়নি। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণ অনুরোধ পাঠায়। ভারত জবাব দিয়েছিল, তবে শুধু নোট ভারবাল পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করার জন্য।

ঢাকার দ্বিতীয়বারের আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণের অনুরোধের এখনো কোনো জবাব দেয়নি ভারত। গত সপ্তাহে ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর ভারতের বিবৃতি থেকে তাদের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

এক বিবৃতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু বলেছে, তারা রায়টি ‘খেয়াল করেছে’। বিবৃতিটিতে আরও বলা হয়, ‘ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশি জনগণের শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতার সর্বোত্তম স্বার্থে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা সব পক্ষের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করে যাব’।

যদিও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রত্যর্পণের অনুরোধ বিষয়ে একেবারেই কোনো মন্তব্য করেনি। এ মুহূর্তে দিল্লি এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া দেবে—এমন সম্ভাবনা কম। ভারতের স্বায়ত্তশাসিত থিঙ্ক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান মনোহর পারিক্কর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (এমপি–আইডিএসএ) গবেষক স্মৃতি এস পট্টনায়কের মতে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ‘সীমিত কর্মপরিধি ও দায়িত্বসম্পন্ন একটি রূপান্তরকালীন সরকার। ভারত অপেক্ষা করবে, নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই তারা দ্বিপক্ষীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবে।’

বাংলাদেশে যাঁরা শেখ হাসিনার টানা ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের সময় ভুগেছেন, কিংবা জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে চরম সহিংসতায় স্বজন হারিয়েছেন—আইসিটির এই রায় ও শাস্তি একধরনের ন্যায়বিচারের স্বীকৃতি। তবে হাসিনা ভারতে অবস্থান করায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্ভব নয়। তাই তাঁকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি অনেক বাংলাদেশির কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত ও বাংলাদেশ ২০১৩ সালে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি সই করেছিল এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এই চুক্তির আওতাতেই শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য চাপ দেবে। তবে ভারতে হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পক্ষে সমর্থন খুবই কম। তাঁর মৃত্যুদণ্ড রায়ের পর এই সমর্থন আরও কমেছে। ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই তাঁর প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

এর মূল কারণ হলো ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পরিবারের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত সমর্থন করেছিল, যেখানে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন আওয়ামী লীগ ও হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালে মুজিবের হত্যার পর হাসিনা ও তাঁর বোন ভারতে আশ্রয় পান এবং সেখানে ছয় বছর অবস্থান করেন।

শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের আবেগপ্রবণ সম্পর্ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হলো হাসিনার শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে গড়ে ওঠা দৃঢ় রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক। বাংলাদেশে অবস্থানকারী ইসলামপন্থী সংগঠন ও ভারতবিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান দিল্লিতে প্রশংসিত হয়েছিল।

ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগকে শেখ হাসিনা গুরুত্ব দিয়েছিলেন, এর ফলে ভারতও তাঁর স্বৈরশাসনকে শক্তভাবে সমর্থন করেছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের এক ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’কে মৃত্যুদণ্ডের মুখে ফেলে দেওয়ার জন্য প্রত্যর্পণ করা হলে ভারতের অন্যান্য মিত্রদের কাছেও বার্তা যাবে যে দিল্লি নির্ভরযোগ্য বন্ধু নয়।

২০১৩ সালের প্রত্যর্পণচুক্তিতে বলা আছে, কোনো পক্ষ অনুরোধ করলে দুই দেশকেই সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে কি চুক্তির অধীন ভারতকে হাসিনাকে ফেরত পাঠাতেই হবে? প্রয়োজন নেই। চুক্তিতে এমন একটি ধারা আছে, যা বলে, অপরাধ যদি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হয়, তবে প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। যদিও সেখানে আরও বলা আছে যে হত্যা, খুন, ইচ্ছাকৃত হত্যা ইত্যাদি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হবে না। কিন্তু হাসিনা এই অপরাধগুলোয় সরাসরি জড়িত, এটা প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। ভারত আরও যুক্তি দিতে পারে যে হাসিনার বিচার সুষ্ঠু হয়নি এবং আইসিটি বেআইনি ও অসাংবিধানিক।

ধরে নেওয়া যাক ভারত ঢাকার অনুরোধে ইতিবাচক সাড়া দিল। তবু সামনে লম্বা ও জটিল প্রক্রিয়া অপেক্ষা করছে। এতে ভারতে পূর্ণাঙ্গ প্রত্যর্পণ বিচার অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দেওয়ার সুযোগ পাবেন।

অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা—উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ অনেক বড়। তাই আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত ভারত এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো অবস্থান নেবে না।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো শিগগিরই তাদের নির্বাচনী প্রচার শুরু করবে। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনীতিতে ভোট পাওয়ার জন্য ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দেওয়ার কৌশল বহুদিনের এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই নির্বাচনী প্রচারে বাংলাদেশি দলগুলো ভারতের প্রতি হাসিনার সমর্থন এবং তাঁকে প্রত্যর্পণে ভারতের অনীহাকে লক্ষ্য করে সমালোচনা করবে—এটাই স্বাভাবিক।

গত বছর হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক টানাপোড়েনে আছে। আর এ ইস্যুকে ঘিরে সেই সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

সূত্র: দ্য ডিপ্লোম্যাট

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved Meherpur Sangbad © 2025