শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫, ০৭:৫৩ পূর্বাহ্ন
শেখ হাসিনাকে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ৫০ শতাংশ ব্যালট বাক্স ভরে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী। জুলাই বিপ্লবের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষীতে দেওয়া জবানবন্দিতে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
চলতি বছরের ২৪ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে পাঁচ পৃষ্ঠার ওই জবানবন্দি দেন তিনি। পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ তার রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন মঞ্জুর করে।
দেশব্যাপী গুম, নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের নির্দেশনাগুলো আসত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। সরাসরি নির্দেশনা দিতেন সরকার প্রধানের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক। এসব কার্যক্রমের অনেক কিছুই পুলিশের সর্বোচ্চ পদে থেকেও জানতেন না সাবেক আইজিপি মামুন।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি আরো বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে জিন বলে ডাকতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। কেননা বিরোধী দলমত দমনে এবং নির্যাতনে তার জুড়ি মেলা ভার। তার গঠিত নৃশংস টিমের মাধ্যমে নানা ধরনের লোমহর্ষক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হতো ।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, কাউকে উঠিয়ে আনা, গুম করে রাখার মতো বিষয়গুলো সাবেক সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল তারিক সিদ্দিক সরাসরি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতেন। এ ব্যাপারে পুলিশের আইজিপি হওয়া সত্ত্বেও আমাকে সবকিছু অবহিত করা হতো না। ব্যারিস্টার আরমান টিএফআই সেলে বন্দি ছিলেন, বিষয়টি তিনি জানতে পারেন আইজিপি হওয়ার পর। কিন্তু ব্যারিস্টার আরমানকে তার আগেই আয়নাঘরে গুম করা হয়েছিল।
এডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল (অপারেশন) ও ডিরেক্টর (ইন্টেলিজেন্স) সরোয়ার বিন কাশেমও আরমানের আটকের বিষয়টি আমাকে অবহিত করেন। তাকে তুলে আনা এবং বন্দি করে রাখার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল। তাকে টিএফআই সেলে আটক ও গুম করে রাখার বিষয়টি আমি পরে জেনেছি। বিষয়টি জানার পরে আমি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে কথা বলি। তারিক সিদ্দিক আমাকে বলেন, ঠিক আছে রাখেন, বিষয়টি আপনাকে পরে বলব। পরে তিনি আমাকে কিছুই জানাননি। এরপরও আমি বিষয়টি কয়েকবার তারিক সিদ্দিকের কাছে উত্থাপন করি, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে আর কোনো নির্দেশনা দেননি। আমি ডিরেক্টর জেনারেল (র্যাব) হিসেবে দায়িত্বভার হস্তান্তরের সময় পরবর্তী ডিরেক্টর জেনারেল (র্যাব) খুরশিদ হোসেনকে আরমানের বিষয়টি অবহিত করি।
চৌধুরী মামুন বলেন, আমার র্যাবের দায়িত্ব পালনকালীন যারা ডিরেক্টর (ইন্টেলিজেন্স) হিসেবে কাজ করেছেন তারা হলেন- সারওয়ার বিন কাশেম, খায়রুল ইসলাম ও মশিউর রহমান। আমি র্যাবে দায়িত্ব পালনকালীন টিএফআই সেলের বিনা বিচারে বন্দিদের আটক রাখা এবং নির্যাতন করা বা কাউকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার কিছু কিছু বিষয় জানতাম, কিন্তু আমি কোনো তদন্ত করিনি বা এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেইনি। কারণ, এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো অন্যান্য বাহিনীর এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে আসত এবং তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করত। এমনকি পুলিশ প্রধান হয়েও আমি র্যাবের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেইনি। কারণ, বিষয়গুলো গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বাস্তবায়ন করত এবং কিছু কিছু বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের কাছ থেকে নির্দেশনা আসত। অনেক ক্ষেত্রে আমার কথাকে গুরুত্ব দিত না।
জবানবন্দিতে তিনি আরো বলেন, র্যাব যেসব অভিযান পরিচালনা করে সেগুলোর অধিকাংশ গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ও পরামর্শের ভিত্তিতে করে। এ ব্যাপারে আইজিপিকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করা হতো না। র্যাবের আলেপ উদ্দিন এবং মহিউদ্দিন ফারুকীকে আমি চিনতাম। আলেপ প্রথমে নারায়ণগঞ্জে র্যাবে ছিলেন, পরে এডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল (অপারেশন)-এর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে র্যাব (ইন্টেলিজেন্স)-এ পদায়ন করা হয়।
র্যাব (ইন্টেলিজেন্স)-এ অনেক অফিসার ছিলেন। গুমসহ বিভিন্ন অপেশাদার কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে আলেপের বিশেষ দক্ষতার জন্য তাকে র্যাবের অফিসাররা পছন্দ করতেন। কারণ, তিনি এই কাজে পুলিশ অফিসারদের মধ্য থেকে নিয়োজিত অফিসার হিসেবে বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত র্যাবের বাকি অফিসারদের অধিকাংশই ছিল মিলিটারি অফিসার। কাউকে উঠিয়ে আনা, গুম করে রাখার মতো বিষয়গুলো জেনারেল তারিক সিদ্দিক সরাসরি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতেন। এ ব্যাপারে পুলিশের আইজিপি হওয়া সত্ত্বেও আমাকে সবকিছু অবহিত করা হতো না।
তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই জুলাই আন্দোলন দমনে ব্যবহার হয় মারণাস্ত্র ও হেলিকপ্টার থেকে গুলি। শেখ হাসিনার নির্দেশনার কথা সে সময়ে পুলিশ প্রধানকে সরাসরি জানান তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আন্দোলন দমনের পরিকল্পনা হতো প্রতি রাতের বৈঠকে।
যেখানে তিনি বলেছেন, গত বছরের ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠক হতো তাদের। বৈঠকে দুই সচিব, এসবি প্রধান মনিরুল, ডিবির হারুন, র্যাবের মহাপরিচালক, আনসারের ডিজি, এনটিএমসির জিয়াউল আহসানসহ অনেকে উপস্থিত থাকতেন। মূলত এ বৈঠকে সব পরিকল্পনা হতো।
এর আগে আমার দেশ-এ সাবেক আইজিপি মামুনের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়টি বলা হয়েছিল। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, জবাববন্দিতে ২০১৩ সালের পর থেকে সব নির্বাচনে কীভাবে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছিল। পুলিশের গ্রুপিং, পুলিশের গোপালগঞ্জ-ফরিদপুর গ্রুপ, হিন্দু কর্মকর্তাদের প্রভাবশালী বলয়, পুলিশের চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করা, র্যাবকে দিয়ে অপহরণ, গুম ইত্যাদি বিষয়।