শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:২০ অপরাহ্ন
পতিত আওয়ামী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশে পর্দানশীন নারীদের বৈঠক করা যেন ছিল অঘোষিত অপরাধ। বিশেষ করে মহিলা জামায়াতের নেতাকর্মীদের একসঙ্গে বসা অনেকটাই অসম্ভব ছিল। ইসলামী বইপত্র নিয়ে এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডের খবর পেলেই ‘জঙ্গি সম্পৃক্ততা ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ তোলা ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বাভাবিক কাজ।
কোরআন-হাদিসের আলোচনা তথা ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকেও নারী কর্মীদের গ্রেপ্তার-নির্যাতনের বহু ঘটনা ঘটেছে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সময়ে। গর্ভবতী নারী কিংবা ছোট শিশুসহ মায়েরাও রেহাই পাননি তাদের জুলুম-নির্যাতন থেকে। চরম প্রতিকূল ওই পরিস্থিতিতে সক্রিয় নেতাকর্মী ছাড়া জামায়াতের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহ হারান সাধারণ নারীরা।
তবে জুলাই বিপ্লবে স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। অন্যদের মতো সাংগঠনিক কাজের অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগ। আর এই সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরদার করেছে তারা। বরং সাংগঠনিক কাজের গতি-কৌশল ও গণ্ডি বাড়িয়ে এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতেও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন দলটির নারী নেতারা। বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে মহিলা জামায়াতের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী তৎপরতা বেড়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, জামায়াতে ইসলামীর স্বতন্ত্র একটি শাখা হিসেবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যক্রম চালায় মহিলা বিভাগ। গঠনতন্ত্রের চতুর্থ অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিভাগের কাজের উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য একটি মজলিসে শূরা থাকবে যার নাম হবে কেন্দ্ৰীয় মহিলা বিভাগীয় মজলিসে শূরা, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াত আমির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ/নির্বাহী পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করে কেন্দ্রীয় মহিলা মজলিসে শূরায় প্রতিনিধিত্বের আনুপাতিক হার ও এলাকা নির্ধারণ করবেন। একইভাবে তিনি কেন্দ্রীয় মহিলা বিভাগীয় মজলিসে শূরার সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি নিযুক্ত করবেন যার পদবী হবে সেক্রেটারি, মহিলা বিভাগ অথবা মহিলা বিভাগীয় সেক্রেটারি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
তিনি জামায়াত আমির বা তার প্রতিনিধির কাছে শপথ গ্রহণ করবেন। বর্তমানে জামায়াতের নেতৃত্বে প্রায় ৪৫ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব রয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, দলীয় গঠনতন্ত্র ও ঐতিহ্য অনুযায়ী মহিলা জামায়াত শুধু মহিলাদের মাঝে দাওয়াতি ও সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। এছাড়া সাংগঠনিক কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য মূল নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকেন। মূলত, ঘরোয়া পরিবেশেই সংগঠনিক কার্যক্রম এতদিন সীমাবদ্ধ ছিল। তবে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনে প্রতিনিধিত্বসহ বিভিন্ন নির্বাচনের জন্য দলের পক্ষে দেশব্যাপী প্রচার কার্যক্রমে সরব থাকতে দেখা গেছে।
তবে গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সর্বত্র জামায়াতের অবস্থান শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি মহিলা বিভাগের কাজের গতিও অনেকে বেড়েছে। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত সংগঠনটির তৎপরতা জোরদার হয়েছে। মহিলা নেতাদের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক প্রোগ্রামে পর্দা রক্ষা করে পুরুষ নেতারাও বক্তব্য দেন। আগামী নির্বাচনে জনগণের রায় পেলে সরকার গঠনের মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। সে অনুযায়ী রাজনৈতিক অঙ্গনে দলের মহিলা বিভাগও বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিলের দিকে নারীবিষয়ক সংস্কার প্রস্তাবে ইসলামবিরোধী বিষয় প্রস্তাবের প্রতিবাদে জামায়াতের মহিলা কর্মীদের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি।
এছাড়া ২১ জুলাই জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতের সময় দলের শীর্ষনেতাদের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো মহিলা নেত্রীদেরও উপস্থিতি দেখা যায়। বৈঠকে মহিলা জামায়াতের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতকে একটি জামদানি শাড়িও উপহার দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলাদা ও যৌথভাবে সাক্ষাতের খবর পাওয়া যায়। এ সময় বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে জামায়াতের কর্মকাণ্ড, নারীদের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে জামায়াতের পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া বর্তমানে দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে সেমিনার-গোলটেবিল বৈঠকেও জামাাতের মহিলা বিভাগের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়ে মতামত তুলে ধরছেন।
জামায়াতের মহিলা বিভাগের বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, জামায়াতে ইসলামী তাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চার দফার আওতায় দেশব্যাপী নানামুখী কর্মসূচি নিয়ে থাকে। মহিলা বিভাগ তা থেকে আলাদা নয়। দলীয় নির্দেশনার বেশির ভাগই পুরুষ ও মহিলা উভয় জনশক্তির জন্য প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে পার্থক্য হলো মহিলা বিভাগ শুধু নারীদের মাঝে কাজ করে থাকে।
সূত্র জানায়, মহিলা বিভাগ কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত দেশের সব নারীদের কাছে নিয়মিত কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে জীবন গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় সৎ নেতৃত্ব থাকার সুফল তুলে ধরছে। আগ্রহী কোরআনপ্রেমী মা-বোনদের সংগঠনভুক্ত করার মাধ্যমে তাদের নৈতিক জীবনমান উন্নয়নের ধারাবাহিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের পাশে দাঁড়াতে নিয়মিত তাদের আর্থিক সহায়তা, চিকিৎসাসেবা, প্রসূতি ও মাতৃত্বকালীন সেবা, সুদমুক্ত করজে হাসানাসহ নানা সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সংস্কারমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সরকারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শিশু ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানববন্ধন সেমিনার ও আলোচনা সভা করছে।
আগের তুলনায় বর্তমানে কাজের সুযোগ বেড়েছে জানিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, মহিলা বিভাগের নেতাকর্মীরা বিগত বছরগুলোতে জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও আমাদের কোরআন শিক্ষার আয়োজন থেকে সাধারণ নারী ও আমাদের সমর্থকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ কারণে আমরা প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাতে পারতাম না। আলহামদুলিল্লাহ স্বৈরাচারমুক্ত দেশে জামায়াতের মহিলা বিভাগ তাদের সব কার্যক্রম প্রকাশ্যে করতে পারছে। ভয়মুক্ত পরিবেশে সব কার্যক্রমে সাধারণ নারীরা অভাবনীয় সমর্থন জানাচ্ছেন।
সূত্র মতে, মহিলা জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রমে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে আগামী নির্বাচন। কর্মী ও রুকন বৃদ্ধির নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সঙ্গে জনসংযোগ করছেন তৃণমূলের নেতারা। এ সময় ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে ইসলামের বিধিবিধান অনুসরণের আহ্বান জানিয়ে আলোচনার পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনে সৎ নেতৃত্বকে তথা জামায়াত প্রার্থীদের বিজয়ের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। সব নারীর মাঝে জামায়াতের দাওয়াত ও আহ্বান পৌঁছানোর টার্গেট নিয়ে গণসংযোগ চালাচ্ছেন সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। সেই সঙ্গে নির্বাচনি খরচের জন্য সংশ্লিষ্টরা বিশেষ ফান্ড তৈরি করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাঠপর্যায়ে বিশেষ করে সাধারণ নারীদের মধ্যে জামায়াতের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বাড়ছে। কিছু বাধা-বিপত্তি থাকলেও তা উপেক্ষা করে কাজের গতি বাড়াচ্ছেন নেতাকর্মীরা।
জামায়াতের কার্যক্রম প্রসঙ্গে মহিলা বিভাগের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবা আক্তার চৌধুরী সুইট বলেছেন, আমাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা আছে যে, জামায়াত নারীদের বোরকা পরিয়ে ঘরের মধ্যে বসিয়ে রাখে। ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আমাদের প্রশ্ন করা হয়েছিলÑতোমরা কি চাকরি করতে পারো? আমার স্বামী ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জবাব দিয়েছিলেন যে, মেয়েদের বন্দি করে রাখলে আমরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হব। কারণ আমার স্ত্রী রেডিওলজি বিভাগের প্রধান, এক মেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অন্য দুই ছেলেমেয়ে ডাক্তার ও আর্কিটেক।
ডা. হাবিবা বলেন, জামায়াত চায় মেয়েরা তার যোগ্যতা ও কোয়ালিটিটা কাজে লাগাক। জামায়াতের মজলিসে শূরা ও নির্বাহী পরিষদেও ৪৩ শতাংশ প্রতিনিধি আছে। আমরা নারীদের ন্যায্যতার ভিত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তবে সামাজিক মোটিভেশন ও নৈতিক শিক্ষা ছাড়া নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন-নারী প্রয়াসের সেক্রেটারি ড. ফেরদৌস আরা খানম বলেন, মহিলা জামায়াতের বর্তমান কার্যক্রমকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখছি। এই কার্যক্রমকে আরো শক্তিশালী করা উচিত।
তিনি বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মহিলা জামায়াতের শাখা আছে। এতদিন বৈরী পরিবেশের কারণে ঠিকমতো কাজ করতে না পারলেও এখন সুযোগ এসেছে। এখন পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার চেষ্টা করতে হবে। শুধু নারী ইস্যুতেই নয়, দেশ ও জাতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাদের ভূমিকা থাকতে হবে।
ড. ফেরদৌস আরা খানম আরো বলেন, জামায়াতের মহিলা নেত্রীদের অনেকেরই বড় বড় প্রতিষ্ঠান চালানোর অভিজ্ঞতা আছে। সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাশেম আলীর স্ত্রী, বর্তমান নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেহের স্ত্রী, মহিলা জামায়াতের কেন্দ্রীয় সভানেত্রীসহ অনেকেই ব্যবসা ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তিজীবনে ইসলাম চর্চাকারী নারী হয়েও বাইরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তারা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আগামীতে জনগণের রায় নিয়ে জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নিশ্চয় তাদের মহিলা নেত্রীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন তিনি।