সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪৮ অপরাহ্ন
প্রতীক নিয়ে মুখোমুখি এনসিপি ও নির্বাচন কমিশন। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নতুন দল এনসিপির অবস্থান-তারা শাপলা প্রতীক না পেলে নিবন্ধন নেবে না। ইসির বেঁধে দেওয়া প্রতীক পছন্দের শেষ দিনেও দলটি প্রতীকের বিষয়ে তাদের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছে।
বলেছে, শাপলা প্রতীক নিয়েই নির্বাচনে যাবে দলটি। অপরদিকে ইসি তালিকার বাইরে কোনো প্রতীক বরাদ্দ দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তালিকাভুক্ত প্রতীক থেকে এনসিপি তাদের পছন্দ না জানানোয় কমিশন তাদের নিজস্ব পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতীক বরাদ্দ দেবে। যেকোনো সময় কমিশন থেকে এ সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে।
এদিকে প্রতীক নিয়ে এনসিপি ও নির্বাচন কমিশনের মুখোমুখি অবস্থানে নতুন সংকট তৈরি করছে। দুই পক্ষের ‘নো রিটার্ন পজিশন’ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। বিষয়টির দ্রুত সুরাহা প্রত্যাশা করে তারা বলেছেন, সরকারের স্পষ্ট ঘোষণার পরও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের নির্বাচন নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এনসিপির প্রতীকের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষীরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতিতে উত্তরণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে তাতে বাধার সৃষ্টি হতে পারে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যান। হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল ছাত্র-জনতা। সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে ওই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকরী ছাত্ররা গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে নতুন দল গঠন করে। দলটি ‘শাপলা’কে তাদের দলীয় প্রতীক হিসেবে ঘোষণা করে। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পেতে আবেদন করে দলটি। নিবন্ধনের আবেদনে তাদের প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’ রাখার কথা বলা হয়।
জানা গেছে, দলটি শাপলা ছাড়াও বিকল্প হিসেবে ‘কলম’ ও ‘মোবাইল’ প্রতীকও উল্লেখ করেছিল। তবে পরবর্তী সময়ে তা সংশোধন করে কেবল ‘শাপলা’কে প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে।
এদিকে নির্বাচন কমিশন দীর্ঘ যাচাই-বাছাই করে এনসিপিসহ কয়েকটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর কমিশনের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এনসিপির নিবন্ধন চূড়ান্ত হলেও প্রতীক নিয়ে আটকে গেছে নিবন্ধনের আদেশ। নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে শাপলা প্রতীক দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানানো হয়। এ সময় ইসির তফসিলভুক্ত প্রতীকগুলোর নাম উল্লেখ করে এনসিপিকে সেখান থেকে প্রতীক পছন্দ করার কথা বলা হয়। তবে শাপলা প্রশ্নে এনসিপি তাদের কঠোর অবস্থানের জানান দেয়। তারা কমিশনের সঙ্গে দেখা করে তাদের অবস্থান জানায়। একই সঙ্গে শাপলা প্রতীকের বেশ কয়েকটি ‘আকৃতির’ ছবি ইসির কাছে জমা দিয়ে তার মধ্যে যেটি দেওয়া হয় তা মেনে নেবে বলে জানানো হয়।
অবশ্য নির্বাচন কমিশন তা আমলে না নিয়ে শাপলা প্রতীক না দেওয়ার অবস্থানে অনড় থাকে এবং ৫ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে ১৪ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ১৯ অক্টোবরের মধ্যে ইসির তফসিলের মধ্যে থাকা প্রতীক বেছে নিতে হবে এনসিপিকে। তা না হলে কমিশন নিজ বিবেচনায় এনসিপিকে প্রতীক বরাদ্দ দিয়ে দেবে।
গতকাল বেঁধে দেওয়া ওই সময়ের শেষ দিনে এনসিপির একটি প্রতিনিধি দল ইসি সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চার দফা দাবি জানিয়ে লিখিত ব্যাখ্যা চায়। দলটির প্রতীক অন্তর্ভুক্তি বা বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের বিদ্যমান নীতিমালা বা মানদণ্ড কী, এবং কোন আইনি ভিত্তিতে ‘শাপলা’, ‘সাদা শাপলা’ বা ‘লাল শাপলা’ প্রতীককে বর্তমান তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়।
রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলাকালে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ১১৫টি প্রতীককে তফসিলভুক্ত করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। সর্বশেষ তফশিলভুক্ত প্রতীক ছিল ৬৯টি। এর মধ্যে দলীয় প্রতীক ছিল ৪৪টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ছিল ২৫টি। ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে প্রতীক তফসিলভুক্ত করার জন্য যে ফাইল উত্থাপন করা হয়েছিল সেখানে অন্য প্রতীকের সঙ্গে শাপলা ও দোয়েল প্রতীকও ছিল। তবে কমিশনে উত্থাপনের পর এই দুটি প্রতীককে বাদ দেওয়া হয়।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব ও নির্বাচন-সংক্রান্ত কমিটির সদস্য জহিরুল ইসলাম মুসা আমার দেশকে বলেন, শাপলা ছাড়া অন্য কোনো প্রতীক নির্বাচন কমিশনের দেওয়ার আইনত সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশন যদি তাদের মতো করে কোনো প্রতীক বরাদ্দ দেয় তা আমরা গ্রহণ করব না। এক্ষেত্রে রাজপথের মাধ্যমে আমরা অধিকার আদায় করে নেব। প্রতীক নিয়ে আদালতে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।
গতকাল ইসি সচিবের সঙ্গে সাক্ষাতের পর এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, এনসিপি শাপলা প্রতীক নিয়েই নির্বাচনে যাবে। এর কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন আগের মতোই বর্বর স্বৈরাচারী কায়দায় চলছে। বর্তমান কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে সক্ষম নয়। নির্বাচন কমিশন অন্য কারো রিমোট কন্ট্রোল বা প্রেসক্রিপশনে পরিচালিত হচ্ছে।
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী আমার দেশকে বলেন, অন্য প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার অপশন ইসির নেই। জনগণের প্রতীক শাপলা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে।
গতকাল এক অনুষ্ঠানে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছি। নির্বাচন কমিশন কাউকে খুশি করার জন্য এ সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন আমাদের দেখাক কোন আইনে শাপলা প্রতীক এনসিপিকে দেওয়া যাবে না।
অপরদিকে গতকাল সিলেটে এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বর্তমান প্রতীক বরাদ্দ বিধিমালায় শাপলা প্রতীক না থাকায় সেটি কোনো রাজনৈতিক দলকে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, তাই কমিশনের কাজ পুরোপুরি আইন ও বিধির আওতায় পরিচালিত হয়।
এ বিষয়ে চানতে চাইলে নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুল আলীম আমার দেশকে বলেন, দুপক্ষই যখন তাদের যুক্তিতে অনড়, এক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের একমাত্র স্থল আদালত। এক্ষেত্রে এনসিপি বা যে কেউ রিট করতে পারে। আদালত থেকেই একটি সুরাহা আসবে।
এনসিপির নিবন্ধন নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারেÑএমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেন, এনসিপি তো বলে দিয়েছে তারা শাপলা না পেলে নিবন্ধন নেবে না। নিবন্ধন না পেলে নির্বাচনে যাবে না। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বাদানকারী একটি দল, যাদের নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপনের কারিগর বলা হয়। তারা নির্বাচনে না গেলে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আসবে। নির্বাচনও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না। তারা নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলনে গেলে তা আরো বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান আমার দেশকে বলেন, নির্বাচন কমিশন তার বিদ্যমান বিধিবিধানের আলোকে সন্তোষজন হলে শাপলা প্রতীক বরাদ্দ দিতে পারে। আর যদি দিতে না চায়, কেন দেবে না সেটাও ব্যাখ্যা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে এনসিপির বিপক্ষে সিদ্ধান্ত গেলে তাদের আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। আদালত থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। তবে আমি মনে করি শাপলার বিষয়ে রাষ্ট্রের অবস্থানও স্পষ্ট করা উচিত। রাষ্ট্র কি শাপলা, ধানের শীষ ও তারাসহ রাষ্ট্রীয় প্রতীকের সব অংশ একই ভাবে মূল্যায়ন করে, নাকি শাপলার ক্ষেত্রে তাদের ভিন্ন অবস্থান রয়েছে, সেই ব্যাখ্যাটা সরকারের তরফ থেকে এলে অনেক বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে।
এনসিপির শাপলা প্রতীককে কেন্দ্র করে নতুন নিবন্ধন প্রক্রিয়া আটকে যাওয়াসহ যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা আগামী নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক উত্তরণে কোনো প্রভাব ফেলবে কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নানা অংশ থেকে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের অনিশ্চয়তার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও এ অনিশ্চয়তায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। ভেতরে কতটা এগিয়েছে সেটা বলতে পারব না। তবে এই কমিশন দেড় বছরে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম দেখাতে পারেনি। মনে হয়নি তারা নড়েচড়ে বসেছে। বরং তারা হেলাফেলায় সময় নষ্ট করেছে। প্রতীক নিয়ে শেষ সময়ে যে জটিলতা তৈরি হলো, বেশ আগেই এর সুরাহা হওয়ার সুযোগ ছিল। অতীতে তিন মাসের মধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই সক্রিয় হলে সামনে এখনো যে সময় আছে, তাদের পক্ষে নির্বিঘ্নে ভোট সম্পন্ন করা সম্ভব। ইসির উচিত হবে জটিলতা কাটিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আরো সক্রিয় হওয়া।
এর আগে বিশিষ্ট আইনজীবী শিশির মনির এক টেলিভিশন টকশোতে অংশ নিয়ে বলেন, শাপলা প্রতীকে আইনগত কোনো বাধা নেই।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ আমার দেশকে বলেন, এনসিপিকে দেওয়া সময় শেষ হওয়ায় কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কমিশন থেকে সচিবালয়ের কাছে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। কমিশন যখন যেভাবে নির্দেশনা দেবে, আমরা তা বাস্তবায়ন করব।
নির্বাচন নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, এ প্রশ্নের জবাব দেওয়াটা আমার এখতিয়ারভুক্ত নয়।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে প্রতীকের যে খসড়া করা হয়েছিল, সেখানে দোয়েল ও শাপলা প্রতীক ছিল। পরে কমিশন তা বাদ দিয়েছে, এটি সত্য কি নাÑজানতে চাইলে সচিব বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই।